Mahamuni Balmiki Biography_Bengali
মহামুনি বাল্মীকি
|
মহাভারতের মতো রামায়ণও ভারতবর্ষের আর একটি মহাকাব্য। মহাভারতে আছে
পারিবারিক জীবনের বাইরের বিস্তৃত কর্মধারার নীতিসমূহ। অন্যদিকে রামায়ণে পারিবারিক জীবনের আদর্শসমূহ
বর্ণিত হয়েছে।
মানুষের
কাছে গৃহই হ’ল তার আশ্রম। এই গৃহাশ্রমের প্রতিটি
সদস্যের সম্পর্ক যে কিরূপ মহান ও সুন্দর হতে পারে, তা
রামায়ণ পাঠ ক’রে জানা যায়।
রামায়ণ
মহাকাব্য ভারতীয় পরিবারের অনুকূল আদর্শ হিসাবে স্বীকৃত হয়েছে। রামায়ণের কাহিনী
ভারতীয় পরিবারকে উজ্জীবিত ক’রে তুলেছে, প্রাণে
পূর্ণতা লাভ করেছে।
মহামুনি
বাল্মীকি রামায়ণ মহাকাব্য রচনা করেন। তিনি এই মহাকাব্যের প্রাণপুরুষ ও অন্যতম
চরিত্র।
বাল্মীকির
জীবন-কাহিনী খুবই আশ্চর্যজনক। শুভবোধ যে কীভাবে মানুষের জীবনে আমূল পরিবর্তন এনে
দিতে পারে, তার একমাত্র উদাহরণ হতে পারে বাল্মীকির
জীবন।
একজন দস্যু
কীভাবে মহামুনিতে রূপান্তরিত হতে পারেন, তার জলজ্যান্ত প্রমাণ হলেন মহামুনি
বাল্মীকি।
যৌবনে
বাল্মীকি ‘দস্যু রত্নাকর’ নামে পরিচিত ছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি ‘মহামুনি’ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেন।
মহামুনি বাল্মীকি |
প্রাচীনকালে
সুমতি নামে এক ব্রাহ্মণ ছিলেন। দেবদ্বিজে তাঁর খুব ভক্তি ছিল। তাঁর একমাত্র পুত্র
হলেন রত্নাকর।
ব্রাহ্মণ
পরিবারের সদস্য হ’লেও রত্নাকরের দেবদ্বিজে কোনও ভক্তি ছিল
না। শাস্ত্রপাঠ, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন ইত্যাদি
ব্রাহ্মণদের করণীয় কাজগুলো রত্নাকর মোটেও পালন করতেন না। তিনি পিতামাতার খুবই
অবাধ্য সন্তান ছিলেন। সংসারের যাবতীয় কাজ ও দায় তাঁর পিতাকেই পালন করতে হতো।
সুমতি যেখানে
পরিবার নিয়ে বাস করতেন, সেখানে একবার দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। ফলে
তাঁর পক্ষে সংসার পালন করা খুবই দুরূহ হয়ে পড়ল। বাধ্য হয়ে পরিবারের সকলকে নিয়ে
তিনি ঘর ছেড়ে চ’লে গেলেন।
নানা জায়গায়
ঘুরে অবশেষে ক্লান্ত হয়ে তাঁরা এক গভীর জঙ্গলে এসে পৌছলেন। সেখানেই তাঁরা কুটির
তৈরী ক’রে বসবাস করতে শুরু করলেন।
সুমতির
বয়স বেড়ে চলল। ক্রমে তিনি বৃদ্ধ হলেন। অবশেষে তিনি কাজকর্ম করার শক্তি হারালেন। ফলে
সংসারের আয়ের পথ বন্ধ হয়ে গেল। পরিবারের তিনটি প্রাণীর কীভাবে অন্যসংস্থান হবে তার
কোনও নিশ্চয়তা রইল না।
লেখাপড়ার
সঙ্গে রত্নাকরের কোনও সম্পর্ক ছিল না। ফলে তাঁর পক্ষে সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়ল।
রোজগারের অন্য কোনও উপায় না দেখে রত্নাকর দস্যুবৃত্তিকেই বেছে নিলেন।
যে
জঙ্গলে তাঁরা বাস করতেন তার মধ্যে দিয়ে পথিকদের যাতায়াতের জন্য একটি পথ ছিল। রত্নাকর
সারাদিন সেই পথের ধারে গাছের আড়ালে লুকিয়ে থাকতেন। কোনও পথিক সেই পথ দিয়ে এলেই
তাঁর উপর ঝাঁপিয়ে প’ড়ে সর্বস্ব লুঠ ক’রে তাঁকে হত্যা করতেন।
রত্নাকরের
জীবনযাত্রা এভাবেই চলতে থাকল। এইভাবেই তিনি সংসারের দায়ও মিটিয়ে চললেন।
বহু বছর
দস্যু রত্নাকরের কর্মকাণ্ড এভাবেই চলল। তাঁর বিভীষিকাময় দস্যু-কাহিনী নানা দেশে ছড়িয়ে
পড়ল।
এই সংবাদ
দেবলোকেও পৌছে গেল। বিধাতাপুরুষের ইচ্ছে এই বিভীষিকাময় আদর্শ থেকে এক মহান আদর্শে
রূপান্তর। তাই তাঁর আদেশে ৭ জন ঋষি ছদ্মবেশে ঐ জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে তীর্থযাত্রা
করলেন।
দস্যু
রত্নাকর যথারীতি গাছের আড়ালে লুকিয়ে ছিলেন। ঐ ৭ জনকে দেখতে পেয়েই হুংকার দিয়ে
তাঁদের পথ রোধ ক’রে দাঁড়ালেন।
রত্নাকর
বললেন, “তোমাদের কাছে যা ধনসম্পদ আছে, তা এখনই বের ক’রে দাও।
তারপর তোমাদের হত্যা করবো। তার আগে ভগবানের কাছে প্রার্থনাটুকু সেরে নাও।”
রত্নাকরের
সঙ্গে এই পথে যাঁরই একবার দেখা হত তাঁকে আর প্রাণ নিয়ে ফিরে যেতে হত না।
ঐ ৭ ঋষির
মধ্যে ঋষি অত্রি রত্নাকরকে বললেন, “শোনো দস্যু, আমাদের হত্যা করার আগে আমার দু’টো কথা তোমাকে শুনতে হবে। দেখো, আমরা তীর্থযাত্রী। আমাদের কাছে খুব সামান্যই
ধনসম্পদ আছে। এই সামান্য ধনের জন্য তুমি ঋষি হত্যার পাপ বহন করবে কেন...?”
রত্নাকর
অবজ্ঞাভরে বললেন, “দেখুন, আমি
পাপকে মোটেও ভয় পাই না। তার কারণ, এই বৃত্তি পালন ক’রে আমি আমার সংসার প্রতিপালন করি। কেবলমাত্র আমার
নিজের জন্য একাজ করি না।”
ঋষি
অত্রি বললেন, “তাহলে কার জন্য তুমি এপথ বেছে নিয়েছ...?”
দস্যু
বললেন, “আমি পথিকদের হত্যা ক’রে যে ধনসম্পদ লুঠ করি তা দিয়ে আমার পিতা-মাতা, স্ত্রী-পুত্রের ভরণপোষণ করি। অতএব তাঁরাও
নিশ্চয়ই এই পাপের দায় বহন করবেন।”
ঋষি
অত্রি বললেন, “তুমি ভুল করছো। এই পাপের দায় একান্তই
তোমাকে বহন করতে হবে। তোমার সংসারের আর কেউই এই পাপের দায় বহন করবেন না।”
দস্যু এর
প্রতিবাদ করলে ঋষি অত্রি বললেন, “ঠিক আছে, তুমি
আমাদের গাছের সঙ্গে বেঁধে রেখে বাড়িতে গিয়ে তোমার পিতা-মাতা ও স্ত্রী-পুত্রকে
জিজ্ঞাসা ক’রো যে, তাঁরা
তোমার এই পাপের বোঝা বহন করতে স্বীকার করছেন কি...?”
লব ও কুশের সঙ্গে মহামুনি বাল্মীকি |
দস্যু
রত্নাকর পড়লেন বিপাকে। দস্যু হ’লেও তিনি ব্রাহ্মণসন্তান। তাই জন্মগতভাবে
নিজ কর্মফলের চিন্তা তাঁর মনে উঁকিঝুঁকি মারতে লাগল। তিনি গভীর চিন্তায় পড়লেন।
ঋষিদের
গাছের সঙ্গে বেঁধে রেখে তিনি বাড়িতে গেলেন।
প্রথমেই
পিতার কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “পিতা, আমি
দস্যুবৃত্তির দ্বারা আপনাদের ভরণপোষণ নির্বাহ করছি। তাই দস্যুবৃত্তির জন্য যে পাপ
আমার হচ্ছে, তার দায় আপনি নেবেন তো...?”
ছেলের
কথা শুনে বৃদ্ধ পিতা বললেন, “দেখো পুত্র, বৃদ্ধ পিতা-মাতার ভরণপোষণ করা প্রতিটি পুত্রেরই
কর্তব্য। আমার পুত্র হিসাবে তোমার থেকে সেবা গ্রহণ করা পাপ নয়। কিন্তু দস্যুবৃত্তি
ক’রে তুমি যে পাপ সঞ্চয় করেছ তার কোনও দায়
আমি গ্রহণ করতে পারি না।”
পিতার
কথা শুনে রত্নাকর ব্যথিত চিত্তে স্ত্রীর কাছে গেলেন। স্ত্রীও তাঁর পিতার মতেই সায়
দিলেন।
এরপর
রত্নাকর মা ও পুত্রকে একই কথা বললেন। তাঁরাও জানালেন তাঁরাও কেউ তাঁর এই পাপের দায়
বহন করতে পারবেন না।
দস্যু
রত্নাকরের অন্তর্দৃষ্টি লাভ হ’ল। তিনি যথার্থই বুঝলেন যে, এই সংসারে তিনি একেবারেই একা। দিনের পর দিন
জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তিনি সংসারের জন্য যে পাপ কাজ করেছেন, তার দায় একান্তই তাঁর। কেউ তাঁকে সাহায্যের জন্য
এগিয়ে এলেন না।
ঘর থেকে
দ্রুত বেরিয়ে গেলেন দস্যু রত্নাকর। আবার সেই জঙ্গলে ফিরে গেলেন যেখানে তিনি ঋষিদের
গাছের সঙ্গে বেঁধে রেখেছিলেন। ঋষিদের বাঁধন খুলে দিয়ে তিনি ঋষি অত্রির পায়ে লুটিয়ে
পড়লেন এবং কাতর স্বরে পাপমুক্তির পথ ব’লে দিতে অনুরোধ করলেন।
ঋষি
অত্রি তাঁকে সান্তনা জানিয়ে বললেন, “কেবলমাত্র পবিত্র রাম নাম করলেই তুমি
পাপমুক্ত হতে পারো।” রত্নাকরকে রাম নাম জপের পরামর্শ দিয়ে তিনি বিদায় নিলেন।
ঋষি
অত্রির কাছ থেকে মন্ত্রলাভ ক’রে রত্নাকর রাম নাম জপ করতে বসলেন। তাঁর
চিত্ত
চঞ্চল হয়ে উঠেছিল। আত্মশুদ্ধি কীভাবে হবে এই তখন তাঁর একমাত্র চিন্তা।
একটা
গাছের নীচে একাসনে ব’সে তিনি রাম নাম জপ ক’রে চললেন। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের
পর বছর। ক্ষুধা-তৃষ্ণা ভুলে একমনে জপ ক’রে চলেছিলেন।
এভাবে জপ
করতে করতে তাঁর চারপাশে নানা আগাছা গজিয়ে উঠল। তাঁর সারা শরীর ঢেকে গেল বল্মীক বা
উইপোকায়। বল্মীকে তাঁর দেহ ঢেকে গিয়েছিল ব’লে তাঁর নাম হয়েছিল ‘বাল্মীকি’।
রত্নাকর ‘রাম-নাম’ জপ ক’রে
আত্মজ্ঞান লাভ করলেন এবং মহর্ষি হিসেবে বরণীয় হলেন। তাঁর দস্যুবৃত্তির নৃশংসতা
বল্মীকের মতোই ঝ’ড়ে প’ড়ে গেল।
তমসা
নদীর তীরে অপূর্ব সুন্দর এক প্রাকৃতিক পরিবেশে মহর্ষি বাল্মীকি আশ্রম স্থাপন
করলেন। ভরদ্বাজ মুনি তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করলেন।
দেবর্ষি
নারদ একদিন বাল্মীকির আশ্রমে ধর্মালোচনা করতে এলেন। বাল্মীকি তাঁকে বললেন, “হে ঋষিবর, ত্রিভুবনের সব খবর আপনি জানেন। অনুগ্রহ ক’রে আমাকে বলুন, পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে গুণবান, ধর্মজ্ঞ, সত্যবাদী, বীর্যবান আদর্শ পুরুষ কে...? তাঁর নাম ও পরিচয় আমাকে বিস্তারিত জানান।”
দেবর্ষি
নারদ বললেন, “হে মহামুনি, আপনি যে মহান পুরুষের সম্পর্কে জানতে চাইছেন, সেরকম পুরুষ খুবই দুর্লভ। কেবলমাত্র ইক্ষাকু
বংশের অযোধ্যার রাজা দশরথের পুত্র রামচন্দ্র এখন পৃথিবীতে বাস করছেন। তাঁর কাহিনী
আপনাকে শোনাচ্ছি।”
রাজা
দশরথের মৃত্যুর পর রাম রাজা হন। তিনি বাল্মীকির সমসাময়িক ছিলেন। অযোধ্যার দক্ষিণে
প্রবাহিত গঙ্গার দুই উপকূলে বিশাল অরণ্য। সেই অরণ্যের মাঝখান দিয়ে প্রবাহিত তমসা
নদী।
দেবর্ষি
নারদ বিদায় নেবার পর বাল্মীকি তমসা নদীতে স্নান করতে গেলেন। গুরুর বল্কল হাতে
সঙ্গে চললেন শিষ্য ভরদ্বাজ। বাল্মীকির মন-প্রাণ জুড়ে তখন কেবল রামের কথা।
ঘন
অরণ্যের পথ ধ’রে তাঁরা যখন নদীর দিকে যাচ্ছিলেন, তখন একজোড়া ক্রৌঞ্চ (বক) গাছের শাখায় মনের
আনন্দে মিথুনে ব্যস্ত ছিল।
জঙ্গলের
আড়াল থেকে এক ব্যাধ তীর ছুড়ে ক্রৌঞ্চকে বধ করল। ক্রৌঞ্চটি মাটিতে প’ড়ে প্রচণ্ড যন্ত্রণায় কাতরাতে লাগল। ক্রৌঞ্চী এই
দৃশ্য দেখে বিরহে কাতর হয়ে চিত্কার করতে লাগল।
এই করুণ
দৃশ্য দেখে বাল্মীকির মনে একইসঙ্গে ক্রোধ এবং করুণার উদয় হল। সেই মুহূর্তে শোকার্ত
ক্রৌঞ্চীর বেদনায় তাঁর অন্তরের অন্তস্থল থেকে মুখ দিয়ে নিজের অজান্তে বেরিয়ে এল এক
ছন্দময় কবিতা :
"মা
নিষাদ...! প্রতিষ্ঠাঙ ত্বমগম: শাশ্বতী সমা:।
যত্
ক্রৌঞ্চমিথুনাদেকমবধী: কামমোহিতম।।"
অর্থাত্
হে নিষাদ (ব্যাধ), ক্রৌঞ্চের মিথুনের সময় তুই তাকে বধ ক’রে যে জঘন্য কাজ করলি, তার জন্য সমাজে চিরকাল নিন্দিত হয়ে থাকবি।
মহামুনি
বাল্মীকির মুখ থেকে যে ছন্দোবদ্ধ কবিতা আবৃত্তি হ’ল, সেটিই আজ ‘শ্লোক’। রামের জীবনের
সমস্ত ঘটনা এই শ্লোকের মাধ্যমে ছিল ব’লে বাল্মীকিকে বলা হয় ‘আদি কবি’।
শিষ্য
ভরদ্বাজের সঙ্গে আলোচনার সময় প্রজাপতি ব্রহ্মা সেখানে আবির্ভূত হলেন। তিনি
বাল্মীকিকে বললেন, “হে মহামুনি, তুমি যে আবৃত্তি ক’রে শ্লোক তৈরী করলে তা আমারই ইচ্ছায় সম্পন্ন
হয়েছে। দেবর্ষি নারদের কাছে তুমি রামের জীবনের সমস্ত ঘটনা শুনেছ। আমার ইচ্ছা, তুমি তা শ্লোকবদ্ধ ক’রে রচনা কর।”
প্রজাপতি
ব্রহ্মার আদেশে মহামুনি বাল্মীকি এরপর রামায়ণ মহাকাব্য রচনা করলেন। এই মহাকাব্যে
প্রায় ২৪,০০০ শ্লোক অনুকূল ছন্দে লিপিবদ্ধ করা
হয়েছে।