Goutam
Buddha Biography_Bengali
গৌতম বুদ্ধ |
খ্রিস্টপূর্ব ৫৬৭ (মতান্তরে ৫৬৬) অব্দে হিমালয়ের
তরাই অঞ্চলের কপিলাবস্তু (অধুনা নেপালে অবস্থিত) রাজ্যে গৌতম বুদ্ধ তথা বুদ্ধদেব
জন্মগ্রহণ করেন। লুম্বিনী উদ্যানে বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে তাঁর জন্ম। তাঁর পিতা ছিলেন
শাক্যবংশীয় রাজা শুদ্ধোদন এবং মাতা ছিলেন মায়াদেবী। বুদ্ধত্ব লাভের আগে বুদ্ধদেবের নাম ছিল
সিদ্ধার্থ বা গৌতম। মায়ের মৃত্যুর পর মাসী গৌতমীর কাছে মানুষ হওয়ার জন্য তাঁর নাম
হয় গৌতম।
শৈশবকাল থেকেই তিনি ছিলেন শান্তস্বভাব, উদাসী, নির্লিপ্ত। সাংসারিক
সুখভোগ কিংবা বৈভব বিলাসে তিনি কোনও আকর্ষণ বোধ করতেন না। মানুষের দুখ:কষ্ট দেখলে
তাঁর হৃদয় অত্যন্ত ভারাক্রান্ত হয়ে উঠত।
পুত্রের মনের এই ভাবান্তর লক্ষ্য ক’রে শুদ্ধোদন অত্যন্ত
বিচলিত হয়ে ওঠেন। সাংসারিক ভোগের জগতে আসক্ত করার জন্য যশোধরা নামে এক পরমা
সুন্দরী কন্যার সঙ্গে সিদ্ধার্থের বিবাহ দেন। কিন্তু দাম্পত্য জীবন তাঁকে বেশীদিন
আকৃষ্ট করতে পারে না। মানুষের জীবনের অন্তহীন শোক দু:খ নিবারণের তথা মুক্তির উপায়
সন্ধানে তিনি আকুল হয়ে উঠলেন।
সিদ্ধার্থের বয়স যখন ২৯, তাঁর এক পুত্র
সন্তান জন্মাল। তাঁর নাম রাহুল। তিনি বুঝতে পারলেন সংসারের মায়ায় তিনি ক্রমশ বেশী
বেশী ক’রে
আসক্ত হয়ে পড়ছেন। তাই তিনি গৃহত্যাগ করলেন। বেছে নিলেন সন্ন্যাসীর জীবন।
সত্যের সন্ধানে তিনি বহু জায়গায় ঘুরে বেড়ালেন।
অনেক সাধুর সঙ্গে তাঁর পরিচয় হ’ল। তিনি বহু তীর্থ পর্যটন করলেন। অবশেষে গয়ার কাছে ‘উরুবিল্ব’ নামক স্থানে এসে
কঠোর তপস্যায় মগ্ন হলেন।
যোগসাধনা, আত্মপীড়ন এবং কৃচ্ছসাধনার ফলে তাঁর দেহ
শীর্ণ হয়ে পড়ল। অনাহার এবং অনিদ্রায় তিনি দুর্বল হয়ে পড়লেন। তবু তাঁর দিব্যজ্ঞান
লাভ হ’ল না।
তিনি উপলব্ধি করলেন মানসিক একাগ্রতার জন্য দেহ ও মনের সুস্থতা প্রয়োজন। নইরঞ্জনা
নদীতে স্নান ক’রে বোধগয়ায় এক অশ্বত্থ বৃক্ষের তলায় তিনি ধ্যানে বসলেন।
একদিন এক ধনবান বণিক কন্যা সুজাতা তাঁকে দেবতা
মনে ক’রে
মিষ্টান্ন বিতরণ করলেন। মিষ্টান্ন গ্রহণ করার ফলে গৌতম দুর্বল দেহে শক্তি লাভ
করলেন। ধ্যানের গভীরতা বৃদ্ধি পেল। সেই রাতেই তিনি দিব্যজ্ঞান লাভ করলেন। গৌতম
হলেন ‘বুদ্ধ’অর্থাত্ ‘জ্ঞানী’। আর সেই অশ্বত্থ বৃক্ষের নাম হ’ল ‘বোধিবৃক্ষ’। এবং সেই স্থানের নাম
হ’ল ‘বুদ্ধগয়া’।
বুদ্ধত্ব লাভের পর গৌতম ধর্মপ্রচারে মনোনিবেশ
করলেন। তাঁর প্রচারিত ধর্মের নাম বৌদ্ধধর্ম। বারাণসীর কাছে সারনাথের মৃগদাব উপবনে
তিনি সর্বপ্রথম ধর্মপ্রচার করলেন। জীবনের বাকী ৪৫ বছর দূরদুরান্তে ভ্রমণ ক’রে তিনি তাঁর বাণী
প্রচার করেন। ধনী-দরিদ্র, উচ্চবর্ণ-নিম্নবর্ণ, পুরুষ-নারী সকলেই তাঁর প্রচারিত ধর্মে
দীক্ষিত হন। সমসাময়িক অনেক রাজাও বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করলেন। বিম্বিসার, প্রসেনজিত্, এমনকি অজাতশত্রুও
শেষ জীবনে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেন।
গৌতম বুদ্ধ |
বুদ্ধদেব তাঁর শিষ্যদের জন্য সংঘ নামক প্রতিষ্ঠান
গড়লেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল-বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের মধ্যে একতা বৃদ্ধি করা এবং
জাতিভেদজনিত সংকীর্ণতা দূর করা। ধর্মের জটিলতা থেকে মানুষকে তিনি মুক্তির পথ
দেখিয়েছিলেন। ৮০ বছর বয়সে গোরক্ষপুরের কুশীনগরে বুদ্ধদেব দেহত্যাগ করেন। তাঁর
দেহত্যাগকে বলা হয় ‘মহাপরিনির্বাণ’।
ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কে বুদ্ধদেব কিছুই
বলেননি। নিজেকে দেবতা কিংবা দেবতার অনুগৃহীত ব’লেও দাবী করেননি। তিনি ব্রাহ্মণ্য ধর্মের
জটিল আচার-অনুষ্ঠান ও জাতিভেদ প্রথা স্বীকার করতেন না। তবে, কর্মফল ও পুনর্জন্মে
তিনি বিশ্বাস করতেন। তাঁর বিশ্বাস ছিল, মানুষ নিজ কর্মফলের জন্যই দু:খ-কষ্ট ভোগ
করে। তিনি বলতেন,মানুষ বারবার জন্মগ্রহণ করে কারণ তারা বাসনা ও মোহত্যাগ করতে পারে না।
এই জন্মচক্রের হাত থেকে অব্যাহতি পাওয়ার একমাত্র উপায় বাসনার নিবৃতির দ্বারা ‘নির্বাণ’ লাভ।
গৌতম বুদ্ধ |
বুদ্ধদেব পরম সত্যের উপলব্ধির জন্য আটটি উপায়ের
কথা বলেছেন। এগুলিকে‘অষ্টাঙ্গিক মার্গ’ বলা হয়। এগুলি হ’ল-(১)সত বাক্য;(২)সত কর্ম;(৩)সত জীবন যাপন;(৪)সত চেষ্টা;(৫)সত দৃষ্টি;(৬)সত স্মৃতি;(৭)সত সংকল্প এবং(৮)সম্যক সমাধি। পাশাপাশি
তিনি তাঁর শিষ্যদের পাঁচটি আচরণবিধি পালন করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। এগুলি ‘পঞ্চশীল’ নামে পরিচিত। এই
আচরণবিধিগুলি হ’ল-(১)লোভ,(২)হিংসা,(৩)অসত্য,(৪)দুর্নীতি ও(৫)অন্যায় করা থেকে নিবৃত্ত থাকা। বুদ্ধদেব ভোগবিলাস ও
কৃচ্ছসাধনের মধ্যবর্তী পথ অনুসরণের কথা বলায় বৌদ্ধধর্মকে মধ্যপন্থা বলা হয়। চারটি
উপলব্ধির মাধ্যমে বৌদ্ধধর্মের মূল তত্ব প্রকাশিত হয়েছে। এগুলিকে একযোগে ‘চতুরার্য সত্য’ বলা হয়। এগুলি হ’ল-(১)জীবনে দু:খ আছে;(২)দু:খের উত্পত্তির
কারণ বাসনা ও আকাঙ্খা;(৩)বাসনা ও আকাঙ্ক্ষার নিবৃত্তির দ্বারা দু:খের মুক্তি সম্ভব
এবং(৪)অষ্টাঙ্গিক মার্গের দ্বারা বাসনা ও আকাঙক্ষার নিবৃত্তি সম্ভব।
বৌদ্ধধর্ম প্রসারে সংঘের অবদান উল্লেখযোগ্য।
সম্রাট অশোক ও কণিষ্কের উদ্যোগে বৌদ্ধধর্ম বিশ্বধর্মে পরিণত হয়।
গৌতম বুদ্ধ |
বৌদ্ধধর্মের একমাত্র ধর্মগ্রন্থ ‘ত্রিপিটক’। ত্রিপিটক তিনটি
পিটকের সমাহার-(১)সূত্র পিটক,(২) বিনয় পিটক এবং(৩) অভিধম্ম পিটক। সূত্র পিটকে
বুদ্ধদেবের উপদেশাবলি লিপিবদ্ধ রয়েছে। বিনয় পিটকে সংকলিত হয়েছে বৌদ্ধ
সন্ন্যাসী ও ভিক্ষুদের আচরণবিধি। অভিধম্ম পিটকে রয়েছে বৌদ্ধধর্মের তাত্ত্বিক ও
দার্শনিক ব্যাখ্যা।
বৌদ্ধধর্মের বিকাশ ভারতের তথা বিশ্বের ইতিহাসে এক
তাত্পর্যপূর্ণ ঘটনা। সমাজ,অর্থনীতি, শিল্প, সংস্কৃতি, ধর্ম সব ক্ষেত্রেই বৌদ্ধধর্মের প্রভাব
অনস্বীকার্য। বুদ্ধদেব জন্মভিত্তিক বর্ণভেদের বিরোধী ছিলেন। বৌদ্ধধর্ম সামাজিক
সাম্যের বাণী প্রচার করে। বৌদ্ধধর্মের অহিংসার বাণী পশুশক্তি সংরক্ষণের সহায়ক
হয়েছিল। বৌদ্ধধর্ম সাহিত্যের বিকাশে সহায়তা করেছিল। ভারতের বাইরে বৌদ্ধধর্ম
সম্পর্কিত যে সকল গ্রন্থ ধর্মগ্রন্থের মর্যাদা পায় সেগুলিতে রয়েছে বৌদ্ধধর্মের
ইতিহাস এবং জাতকের গল্প। বৌদ্ধবিহারগুলিকে কেন্দ্র ক’রে শিক্ষা ব্যবস্থার প্রসারলাভ ঘটে।
বৌদ্ধধর্মের অবদান রয়েছে শিল্পকলার ক্ষেত্রেও। প্রাচীন ভারতের স্থাপত্য এবং
ভাস্কর্য শিল্পের বিকাশেও বৌদ্ধধর্মের অনেক অবদান রয়েছে। বৌদ্ধধর্মের সেতু বেয়ে
সিংহল, তিব্বত, চীন,সুবর্ণদ্বীপ প্রভৃতি স্থানে ভারতীয় সভ্যতা ও
সংস্কৃতি প্রসারিত হয়েছিল।
No comments:
Post a Comment